যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানানোর বিষয়টিকে দেশটির ‘ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের’ প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন ১৪ দলীয় জোটের নেতারা। একইসঙ্গে ঢাকা-ওয়াশিংটনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কে ফাটল ধরাতে ‘তৃতীয়পক্ষ ষড়যন্ত্র করছে’ বলে দাবি করেন তারা। এজন্য সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার এবং বন্ধুদেশগুলোর কাছে সব বিষয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন জোটের নেতারা।

সোমবার (১৩ ডিসেম্বর) এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় জোট নেতাদের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে আসে।

বিশেষ এই সভায় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, সারা বিশ্বে যখন জঙ্গিবাদ আলোড়িত একটি বিষয়, সেই সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জঙ্গিবাদ নির্মূল করা হয়েছে। জঙ্গি নির্মূলে যে সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে সেই সংস্থাকে আঘাত করা হচ্ছে কেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।

তিনি বলেন, এখানে তৃতীয় কোনো শক্তি আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরানো বা এই ধরনের সিদ্ধান্তের মাধ্যমে এই দেশে পুনরায় জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করার কোনো প্রয়াস আছে কি না বা তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে। যে বাহিনী নারীপাচার রোধ, মাদক চোরাচালান রোধসহ জঙ্গিবাদ নির্মূলে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে তাদের বিষয়ে কেন এমন সিদ্ধান্ত? এই বিষয়টি আরও ভেবে দেখা উচিত এবং তাদের সিদ্ধান্ত বদলানো উচিত।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন কোনো দেশের সরকারকে পছন্দ করে না বা তার ইচ্ছা অনুযায়ী সরকার পরিবর্তন করতে চায়, তখন তাদের ওপর বিভিন্ন দোষারোপ করে। ট্রাম্পের নেতৃত্বে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা হলেও বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে পিছিয়ে গেছে। বাইডেন তো ঘোষণাই দিয়েছে সে বিশ্ব নেতৃত্বে ফিরতে চায়। এজন্য বিভিন্ন দেশকে তাদের বলয়ভুক্ত করার চেষ্টা করছে। এই অঞ্চলেও তারা প্রভাববলয় সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। গণতন্ত্রের সম্মেলনে দাওয়াত না দেয়া সেই ভূ-রাজনীতিরই অংশ।

তিনি বলেন, আমাদের অভ্যন্তরীণ মানবাধিকার নিয়ে এত কথা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকারের কী অবস্থা? সেখানে তো বর্ণ ও লিঙ্গ বৈষম্য প্রকট। সেখানকার জনগণ লড়াই করছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকারের কথা বলে বিশ্ব তখন তা বিশ্বাস করে না।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, এই বিজয়ের মাসে যুক্তরাষ্ট্র কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, এটি দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের সাথে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। সংবিধানের বিধান সমুন্নত রেখেই র‌্যাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। র‌্যাব পুলিশসহ কোনো বাহিনী বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের মতো বাংলাদেশেরও যদি বাহিনীর কোনো সদস্য বিধান ও আইনের বাইরে গিয়ে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড করে তাকে সাজা দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জে সাত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বিচারে সর্বোচ্চ সাজা দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ভূ-রাজনীতির হিসাব-নিকাশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী বাংলাদেশ তার স্বকীয়তা থেকে সরে আসবে না এবং সব ধরনের জোটের বাইরে অবস্থান করেই তার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে যে শক্তি মানতে পারেনি, সেই শক্তি এই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর সময় আমাদের আঘাত করার চেষ্টা করছে। আজ বাংলাদেশে যে বাহিনীটি দেশের আইনশৃঙ্খলা ও জঙ্গিবাদ নির্মূলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে তাদের আঘাত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জঙ্গিবাদকে উস্কে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে, সেই সময়ে আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত দুরভিসন্ধিমূলক এবং এই সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। একাত্তরে যারা আমাদের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি, সেই শক্তি শেখ হাসিনার উন্নয়নকে মেনে নিতে পারছে না।

তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বাশার মাইজভাণ্ডারী নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে নিন্দা জানিয়ে বলেন, এ ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত। স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য অসম্মানজনক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু একটা করা উচিত ছিল। আমেরিকার অ্যাম্বাসেডরকে ডেকে কৈফিয়ত চাইলাম, এটা কিছুই না। আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছি, এজন্য এখন এরকম আরও বিভিন্ন বিষয় আসবে। সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশকে টার্গেট করা হয়েছে, এটা মাথায় রাখতে হবে।

তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অন্যায় করেছে। তারা ব্যাখ্যা চাইতে পারত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আগে লিখিতভাবে জানাতে পারত। সেটা না করে যেটা করল এটা শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ। বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে ভুল তথ্য সরবরাহ করে ভুল বোঝানো হচ্ছে। কেউ যদি মনে করেন বিএনপি-জামায়াতের এতে কোনো হাত নেই তাহলে ভুল করবেন। তারা কিন্তু এসব মিথ্যা তথ্য বলে যাচ্ছে। শুধু বক্তব্য দিয়ে নয়, লবিস্ট নিয়োগ করেছে তারা। সুতরাং আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে

এ সময় তিনি ১৪ দলের পক্ষ থেকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আমেরিকার কাছে ব্যাখ্যা দাবি করেন। একই সঙ্গে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে কূটনৈতিক সম্পর্ক বাড়াতে সরকারকে পরামর্শ দেন।

সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন ব্লেকমেইল করতে চায় তখন তারা এভাবে ব্লেকমেইল করতে করতে অগ্রসর হয়। এভাবে বিভিন্ন সংকট সৃষ্টি করে সরকার পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যায়। আজ এটা কিন্তু সেসবের পূর্ব লক্ষণ। তারা সরকারকে পরিবর্তন করতে চায়। তবে এভাবে ব্লেকমেইল করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাবু করা যাবে না। উনি যে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তা মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে যান।

সভায় আরও অংশ নেন জাতীয় পার্টির (মঞ্জু) সভাপতি রেজাউর রশীদ খান, অ্যাডভোকেট এসকে শিকদার, জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রেসিডিয়াম সদস্য এজাজ আহম্মেদ মুক্তা, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের ডা. ওয়াজেদ ইসলাম খান এবং গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন।

ভার্চুয়াল এ আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃনাল কান্তি দাস।